রোগ বালাই ব্যবস্থাপনা:
তুঁতগাছের রোগ ও তার প্রতিকার
আমাদের দেশে তুঁতগাছের পাতা ও শিকড়ে বেশ কয়েক প্রকার রোগ হয়। এসব রোগের ফলে তুঁতগাছের মারাত্মক ক্ষতি হয় এবং তুঁতপাতার উৎপাদন হ্রাস পায়। রোগগুলো ছত্রাক, ভাইরাস এবং নিমাটোডের কারণে হয়ে থাকে। আমাদের দেশে তুঁতগাছ এবং তুঁতপাতার প্রধান রোগগুলো হ’ল-
তুঁতপাতার ছাতাপড়া (Powdery mildew) রোগঃ
এটি তুঁতপাতার ছত্রাক রোগ। শীতকালে এ রোগ হয়। কোন কোন বছরে আগস্ট থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এ রোগের প্রকোপ থাকে। মেঘলা আবহাওয়ায় এ রোগ হয়। ফাইল্যাকটিনা কোরিলিয়া (Phyllactina corylea) নামক ছত্রাক থেকে এ রোগ হয়।
লক্ষণঃ
১। প্রথমে পাতার নীচের দিকে সাদা পাউডারের মত চাক চাক দেখা যায়। সাদা পাউডার গোটা পাতাতে ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষের দিকে তা কালচে রং ধারণ করে।
২। পাতা ধীরে ধীরে হলুদ ও মচমচে হয়ে যায়।
৩। পাতার Stomata দিয়ে ছত্রাক মাইসেলিয়াম অনুপ্রবেশ করে অভ্যন্তরস্থ পাতার পুষ্টি শোষণ করে থাকে।
৪। পাউডারী মিলডিউ আক্রান্ত পাতাতে পুষ্টি কম থাকার দরুন তা রেশম পোকাকে খাওয়ালে পোকার বৃদ্ধি ভাল হয় না এবং নিম্নমানের রেশম গুটি উৎপাদিত হয়।৫। অনুবীজ কোনিডিয়া (Conidia) এবং এ্যাসকোস্পোরের (Ascospore) মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়।
প্রতিরোধ/প্রতিকারঃ
এ রোগের প্রতিরোধ/প্রতিকার হিসেবে নিম্নের ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা যেতে পারে।
১। তুঁতজমি সঠিক সময়ে প্রুনিং, সেচ, সার ও পরিচর্যা করতে হবে যাতে এ রোগের আক্রমন কম হয় অথবা আক্রমনের সুযোগই না পায়।
২। ০.২% অর্থাৎ ১ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম ডাইথিন এম- ৪৫ অথবা বেলিটন-১২৫ দ্রবণ পাতার নিচের দিক থেকে ১৫ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার ১০ দিন পর পাতা পলুকে খাওয়ানো যাবে।
৩। আক্রান্ত তুঁতপাতায় সিসটেমিক ছত্রাকনাশক ০.২ ভাগ সাত দিন অন্তর অন্তর ছিটাতে হবে।
তুতপাতার দাগ (Leaf spot) রোগঃ
তুঁতপাতার দাগ রোগ হয় সাধারণত বর্ষাকালে এবং মে মাস থেকে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর প্রকোপ দেখা যায়। রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাকের নাম Cercospora moricola।
লক্ষণঃ
১। রোগের শুরুতে পাতার উপরে বাদামী দাগ পড়ে এবং দাগগুলো ক্রমান্বয়ে বেড়ে গিয়ে পাতা আংশিক শুকিয়ে যায়।
২। পাতার সবুজ রং পরিবর্তিত হয়ে হলুদ হয়।
৩। আক্রান্তের চুড়ান্ত পর্যায়ে পাতার বোটা হলুদ হয়ে ডাল থেকে ঝরে পড়ে।
প্রতিরোধ/প্রতিকারঃ
১। তুঁতপাতার দাগ রোগ প্রতিরোধের জন্য গাছ ছাঁটাই- এর পর এপ্রিল/মে মাসে ৩-৫টি পাতা বের হলে ডাইথেন এম-৪৫ ব্যবহার করতে হবে।
২। এছাড়াও এ্যান্ট্রাকল- ৭০ ডব্লিউ পি (ছত্রাকনাশক) এ ০.২ ভাগ দ্রবণ পাতায় চিটালে রোগ দমন করা যায়। তবে ঔষধ ১০ দিন অন্তর মোট ২ বার ছিটাতে হবে। ঔষধ ছিটানোর ১০ দিন পর পলুকে পাতা খাওয়ানো যাবে।
তুঁতপাতার মরিচা (Rust) রোগঃ
রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাকের নাম এ্যাসিডিয়াম মোরি (Accidium mori)।
লক্ষণঃ
১। আক্রান্ত পাতার নিচের অসংখ্য মরিচার মত দাগ দেখা যায়।
২। মরিচা দাগগুলো ক্রমান্বয়ে বাদামী ও কালো রং ধারণ করে।
৩। রোগাক্রান্ত পাতা হলুদ হয়ে অকালে ঝরে পড়ে।
৪। বয়স্ক পাতায় মূলত এ রোগের আক্রমন বেশি দেখা যায়।
প্রতিরোধ/প্রতিকারঃ
শীতকালে সময়মত তুঁতপাতা তুলে পলুপালন করলে এ রোগের আক্রমণের সম্ভাপনা কম থাকে। ডাইথেন এম—৪৫ নামের ছত্রাকনাশক এর ০.২ ভাগ দ্রবণ বা যে কোন সিসটেমিক ছত্রাকনাশক যেমন রিডোমিল এবং ০.১ ভাগ দ্রবণ পাতায় ছিটিয়ে রোগ দমন করা যায়। ঔষধ ছিটানোর ১০ দিন পর পলুকে পাতা খাওয়ানো যাবে।
তুঁতপাতার শিকড় পচা (Root rot) রোগঃ
গত প্রায় ২০/২২ বছর ধরে বাংলদেশে ব্যাপকভাবে গাছতুঁত চাষ চলছে। গাছতুঁত করার জন্য তুঁতচারা জন্মানো হয়। তুঁতচারা জন্মানোর সময় তুঁতচারার পচন রোগ দেখা যায়। এ রোগ তুঁতমুড়া লাগানোর পর ছোট চারাতে দেখা যায়।
লক্ষণঃ
১। কাটিংস থেকে ছোট চারা গজানোর স্থানে পচন ধরে।
২। চারা হলুদ হয়ে মারা যেতে থাকে।
৩। কাটিংস সহ ছোট চারা তুললে দেখা যায় কাটিংস তুলার ন্যায় সাদা ছত্রাকে আক্রান্ত হয়েছে এবং চারার গোড়ায় পচন ধরেছে।
৪। ছোট চারা মারা গিয়ে তুতচারার উৎপাদন হ্রাস পায়।
প্রতিরোধ/প্রতিকারঃ
১। এ রোগের আক্রমণ দেখা দিলে ডাইথেন এম-৪৫ কোজেব বিঘাপ্রতি ৩০০ গ্রাম তুষের সঙ্গে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে খোড় দিয়ে পানি সেচ দিতে হবে।
২। ছত্রাক নাশক রোভরোলও প্রয়োগ করা যেতে পারে।
তুঁতচারার উইল্ট (Sapling wilt) রোগঃ
তুঁতচারার উইল্ট (Sapling wilt) রোগ হয় স্কেলেরোসিয়া রলফসি (Sclerotium rolfsii) নামক এক ধরণের ছত্রাকের আক্রমনের ফলে। জমিতে তুঁত কাটিং রোপনের পর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মাটি উদ্ভুত ছত্রাক (Sclerotium rolfsii) কাটিং এ আক্রমণ করে এবং কাটিং হতে চারা গজালে চারার রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
লক্ষণঃ
১। আক্রান্ত চারা হলুদ হয়ে যায়।
২। আক্রান্ত গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
৩। আক্রান্ত চারা মাটিতে ঢলে পড়ে এবং ১০-১৫% চারা বীজতলাতেই মারা যায়।
প্রতিরোধ/প্রতিকারঃ
১। রোগ প্রতিরোধের জন্য বীজতলা তৈরীর সময় সারের সাথে ৭০০ গ্রাম/বিঘা ডায়থেন এম-৪৫ নামের ছত্রাকনাশক মাটিতে মিশিয়ে নিতে হবে।
২। রোগের আক্রমণ হলে চারার জমিতে বিঘা প্রতি ৭৫০ গ্রাম ডায়থেন এম-৪৫/বিঘা ৫০০ গ্রাম সিস্টেমেটিক ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে পানি দিতে হবে এবং ১০ দিন অন্তর দ্বিতীয় প্রয়োগ রোগ দমন করা সম্ভব।
তুঁতগাছের কৃমি (Root knot) রোগঃ
নিমাটোড রোগকে তুঁতগাছের কৃমি রোগ বা “রুট নট’ ও বলে। মেলয়ডোগাইনী ইনকগনেটা (Meloidogyne incognita) নামক পরজীবী শিকড়ে এ রোগ সৃষ্টি করে। সব ঋতুতেই নিমাটোড রোগ হতে পারে। তবে আগস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত এর প্রকোপ বেশী হয়। সাধারণত: বেলে এবং পাহাড়ী মাটিতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশী লক্ষ্য করা যায়। দোঁয়াশ ও এঁটেল মাটিতেও এ রোগের আক্রমণ হতে পারে।
লক্ষণঃ
১। আক্রান্ত গাছের আকার খাটো হয়ে সজীবতা নষ্ট হয়।
২। গাছের পাতা হালকা হলুদ থেকে গাঢ় হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
৩। সবশেষে গাছ শুকিয়ে মারা যায়।
প্রতিরোধ/প্রতিকারঃ
১। নিরেট বালি মাটিতে তুঁতচারা করা যাবে না।
২। রোগাক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ধ্বংস করতে হবে।
৩। মাটি বিশোধনের জন্য কুরাটার ৫ জি, কেজি/বিঘা ১৫ কেজি হিসাবে ২৮ দিন অন্তর ৩ বার প্রয়োগ করতে হবে।
৪। কুরাটার প্রয়োগের পর জমিতে সেঁচ দিয়ে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। জমিতে নিয়মিতভাবে নিমের খৈল ১৫০ কেজি/বিঘা বছর সার হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।